সারাদেশ

হাশেম ফুডে ৫৪ শ্রমিক হত্যাকান্ডে চার্জশিট বাতিল ও পুনঃতদন্তের দাবি

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার হাশেম ফুড কারখানায় ২০২১ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের প্রাণহানির ঘটনায় মালিক ও তার চার ছেলেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে দাখিলকৃত চার্জশিট বাতিল ও পুনঃতদন্ত করার দাবিতে মানববন্ধন ও শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা। শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১ টায় নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও শহরে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি আবু নাঈম খান বিপ্লবের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি সেলিম মাহমুদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সহসভাপতি এম এ মিল্টন, রি-রোলিং স্টিল মিলস শ্রমিক নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক এস এম কাদির, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শরীফ।

নেতৃবৃন্দ বলেন, হাশেম ফুড লিমিটেডের সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডে ৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার ২ বছর পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে দায়ী কারখানা মালিকদের অব্যাহতি দেয়া এবং ধারা পরিবর্তন করে মামলাকে দুর্বল করা হয়েছে। ২০২১ সালের ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে কর্মকর্তা-শ্রমিকসহ ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক নাজিমউদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ ৮ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। ঘটনার দুই বছর পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির নারায়ণগঞ্জ অফিসের পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান গত ৩ সেপ্টেম্বরে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন তদন্তকালে হাসেম ও তার চার ছেলের বিরুদ্ধে মামলায় জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং অভিযোগে বর্ণিত পেনাল কোড ৩০২/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭ ধারার সত্যতা পাওয়া যায়নি। এজন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা মালিক এবং তার চার ছেলেকে অব্যাহতি দিয়েছেন এবং আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০৪ (ক) ৩৪ ধারায় অবহেলার দ্বারা মৃত্যু সংঘটনের অভিযোগ এনেছেন যে ধারায় একজন আসামির সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, অভিযোগপত্রের ঘটনা বিবরণীতে তদন্ত কর্মকর্তা যে সকল অপরাধের কথা উল্লেখ করেছেন যেমন-৩৪ হাজার ৫০০ বর্গফুটের হাসেম ফুড কারখানার মূল নকশায় তিনটি সিঁড়ি থাকলেও নির্মাণকালে দুটি সিঁড়ি রাখা হয়। ২০২০ সালের ২ মে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ম্যাংগো জুস উৎপাদনের জন্য ছাড়পত্র নেওয়া হলেও সেখানে ম্যাংগো জুসের পাশাপাশি শর্ত ভঙ্গ করে লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, মুড়ি, ক্যান্ডি, জ্যাম-জেলি, আচার, ম্যাংগো বার, সফট ড্রিঙ্ক ইত্যাদি খাবার উৎপাদন হতো। দুই দশমিক ৫৯ একর জমির ছাড়পত্র নেওয়া হলেও অনুমতি ছাড়া নসিলা উৎপাদনের জন্য কারখানা সম্প্রসারণ করা হয়। কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। দূর্ঘটনা কবলিত ভবনে শ্রমিকদের বের হতে ভেতর ও বাইরে থেকে দরজা খোলার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্রতিটি ফ্লোরে নেট দিয়ে শ্রমিকদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল ও সিঁড়ি তালাবদ্ধ ছিল। কারখানায় শ্রমিকদের ফায়ার প্রশিক্ষণ ও ফায়ার কর্মী ছিল না। দূর্ঘটনা কবলিত ভবনের নিচতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত  প্রতিটি ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল। সেই দাহ্য পদার্থের সঙ্গে উৎপাদিত মালামাল মজুদ করে রাখা হয়েছিল। কারখানার ভবনের ভেতরে মেশিন স্থাপনে দূরত্বের লেআউট প্ল্যান মানা হয়নি। নকশা অনুযায়ী কারখানার দক্ষিণ পাশে ২০ ফুট রাস্তা ও পূর্ব পাশে ১০ ফুট এবং পশ্চিম পাশে ২০ ফুট রাস্তা রাখার কথা থাকলেও রাখা হয়নি। কারখানাটি ৬ মাসের শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন নিয়ে করা হলেও সেই শর্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। শিশু আইন অমান্য করে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আগুনে পোড়া অধিকাংশ মৃতদেহ শিশুর  ইত্যাদি কোনোভাবেই মালিকদের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া সংঘটিত হওয়া এবং দিনের পর দিন তা অব্যাহত থাকার সুযোগ নেই। কারখানা নির্মাণ থেকে উৎপাদন পরিচালনার প্রতিটি পর্যায়ে আইন লঙ্ঘনের যে ভয়াবহ চর্চা হাসেম ফুড কর্তৃপক্ষ করেছে তা অবশ্যই মালিকদের ইচ্ছা এবং নির্দেশনায় সংঘটিত হয়েছে। অভিযোগপত্রেও উল্লেখ আছে যে হাসেম ফুডসের মালিক ও তাদের নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের অপরিকল্পনা-অব্যবস্থাপনা জনিত কারণে বৈদ্যুতিক গোলাযোগে সৃষ্ট আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের কারণ তদন্তে প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে অথচ অভিযোগ পত্র থেকে কারখানা মালিক আবুল হাসেম এবং তার ৪ ছেলের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে যা স্ববিরোধিতা।

নেতৃবৃন্দ বলেন, অপরাধের ধরণ মালিকের সম্পৃক্ততা এবং অতিমুনাফার লোভে ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘটিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রমাণ না পাওয়ার কারণ দেখিয়ে কারখানা মালিকদের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া এবং অভিযোগের ধারা পরিবর্তন করে মামলাকে লঘু করে দেওয়া ন্যায়বিচারের মূলে কুঠারাঘাতের সামিল। নেতৃবৃন্দ নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার অধিকার পদদলন কে উৎসাহিত করার এই অভিযোগপত্র প্রত্যাহার করে পুনঃতদন্ত করার জোর দাবি জানান।

Back to top button