সারাদেশ

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা : যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে সরকার

কোন প্রেক্ষাপটে র‌্যাব এবং এর সাত সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ করল, তার ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পাশাপাশি আইনগতভাবে মোকাবেলা করার চিন্তা-ভাবনার অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এবার দেশের স্বার্থে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের কথাও ভাবা হচ্ছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহিরয়ার আলম গতকাল বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এই তথ্য জানান।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যেভাবে সম্পৃক্ত আছে এবং যেভাবে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকা আর বাড়বে না বলে মনে করছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

র‌্যাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে ‘মাত্রাতিরিক্ত’ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অন্য কোনো দেশ বা সংস্থা র‌্যাবের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। এমনকি শান্তিরক্ষী নিয়োগ নিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, তারা দেখেশুনে শান্তিরক্ষী নিয়োগ করে থাকে। এসবের মধ্যেই জাতিসংঘের শান্তি বিনির্মাণ কমিশনের সভাপতি পদে বাংলাদেশ সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়েছে।

শাহিরয়ার আলম বলেন, ‘আমরা জানতে চাচ্ছি, কী কী কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও অর্থ দপ্তর থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং এটির ব্যাপ্তি কতটুকু। এটি আমরা লিখিতভাবে জানতে চেয়েছি। আমাদের বলা হয়েছে, তারা উত্তর দেবে। তবে একটু সময় নেবে। ’

নিষেধাজ্ঞা আর বাড়বে না—যুক্তরাষ্ট্র এমন আশ্বাস দিয়েছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এটি বলতে চাই না। কারণ সেগুলো গোপনীয় আলোচনা। আমি যে কথাগুলো বলছি তার পেছনে সে ধরনের যোগাযোগেরও প্রভাব আছে। ’

শাহিরয়ার আলম বলেন, ‘র‌্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার পর অন্য কারো সমর্থন না পাওয়াও কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ। তারা যে কাজটি করেছে, তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। ’

তিনি বলেন, ‘আমরাও চ্যালেঞ্জ করছি তাদের। কূটনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করছি। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যালেঞ্জ করব। আমরা আমাদের বন্ধুদের অবশ্যই সম্পৃক্ত করব। ’

এর জন্য সরকার যুক্তরাষ্ট্রে আইনি প্রতিষ্ঠান ভাড়া করছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। আমরা সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি। আমরা কথা বলছি। একাধিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা খুব শিগগির সিদ্ধান্তে যাব, এটিও বলতে পারি। ’

গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর একে পুঁজি করে অনেকে সস্তা রাজনীতি করেছে বলে অভিযোগ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার দু-তিন দিনের মাথায়ই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। বিএনপির আরেক নেতা বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। একজন এমপিকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে আপনাদের (সাংবাদিকদের) কাছে বিতরণ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। ’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘র‌্যাব আমাদের দেশের গর্বের একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের অনেক সাফল্যের ভাগিদার র‌্যাব। তাদের ও তাদের কর্মকর্তাদের রক্ষা করা আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সেই জায়গা থেকে আমরা আইনি বিষয়গুলো দেখছি। ’

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আগে আমলে নিলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, যেকোনো দেশ বা সংস্থার উদ্বেগগুলোর জবাবে যুক্তি তুলে ধরেছে সরকার।

র‌্যাবকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহারের অভিযোগ নাকচ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটি যে কতটা হাস্যকর, তার উদাহরণ টেকনাফের ঘটনা। ওই ভদ্রলোক (কাউন্সিলর ইকরাম) আওয়ামী লীগ করতেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন বা সদস্য ছিলেন; এ রকম একাধিক ব্যক্তিও মাদকের সঙ্গে জড়িত বা অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের ধরতে গিয়ে র‌্যাবের বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। ’ তিনি বলেন, র‌্যাব কোনোভাবেই বিএনপি বা জামায়াত দমনে ব্যবহৃত হয়নি।

শাহিরয়ার আলম বলেন, ‘র‌্যাবের মতো কার্যকর বাহিনী যদি ব্যর্থ হয়, তবে তাতে একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে। কারণ তাদের সফলতার পাল্লা এতটাই ভারী, তাদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল বাংলাদেশের জনগণ, সে ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে চাই। তাদের শক্তিশালী করতে চাই। ’

এপ্রিলে সচিবদের বৈঠক, যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী : আলোচনার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী জানান, এপ্রিলে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠক, বাণিজ্য ইস্যুতে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, ‘এগুলো চলমান প্রক্রিয়া। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞায় বাড়তি এজেন্ডা (আলোচ্য বিষয়) হিসেবে যোগ হয়েছে। তবে এটি আমাদের জন্য শীর্ষ এজেন্ডা। ’

জাতিসংঘ থেকে পাঠানো নিখোঁজদের তালিকায় কল্পনা চাকমা, উলফা সদস্য : পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘ থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের যে তালিকা পেয়েছি তার মধ্যে ১৯৯৩ সালে নিখোঁজ ব্যক্তিও আছেন; কল্পনা চাকমা। বিএনপির সময় তিনি নিখোঁজ হয়েছেন। সেটির উত্তরও আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। ’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আবার এমনও আছেন, যাঁরা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের নেতা ছিলেন, তাঁদের নামের তালিকা আমাদের এখানে দেওয়া হচ্ছে। এ রকম আরো একাধিক নাম পেয়েছি। ’ তিনি বলেন, এসব বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। জাতিসংঘকে বিশদ জবাব দেওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও জানানো হবে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নিখোঁজ ৭০ থেকে ৮০ জনের যে তালিকার কথা বলা হয়, এর মধ্যে অর্ধেকের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখছি, তাঁরা কোনো না কোনো সময়ে সরকারদলীয় রাজনীতিক, সমর্থক ছিলেন। ’

লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের ভাবনা : পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার দেশের মঙ্গলের জন্য এবার লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের কথা ভাবছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে এটি করা হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণকে ঘিরে বাংলাদেশের জন্য আগামী বছরগুলো বেশ চ্যালেঞ্জিং। জিএসপি, বাহিনী ও সংস্থার ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এটি প্রয়োজন।

১২ সংস্থার চিঠিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না সরকার : র‌্যাবকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করতে ১২টি মানবাধিকার সংস্থা যে চিঠি দিয়েছে, তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না সরকার। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মোটেও বিচলিত নই। আমরা নিজেরাই এ বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। জাতিসংঘ বলেছে, তারা এই চিঠিকে আমলে নেয়নি। আমরা সজাগ থাকব। ’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সক্ষমতা বৃদ্ধির ইইউয়ের সহযোগিতার আগ্রহ : পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে সুফল পাচ্ছে নারীরা। মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি বিদেশিদের বোঝানো হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিকদের এই আইনের মামলায় সরাসরি গ্রেপ্তার করা হবে না। একটি কমিটি করে দেওয়া হবে। সেই কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হবে।

Back to top button