রাজনীতি

জেল হতে পারে হাজী সেলিমের

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমকে কারাগারে যেতেই হচ্ছে। দুদকের এ মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা বহাল রেখে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে গতকাল। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, মানসিকভাবে দুর্নীতিকে বৈধতা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দেশের প্রতিটি খাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতি একটি মানসিক রোগ। শুধু শারীরিক শাস্তি দিয়ে একে নিরাময় করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী চিহ্নিত করা।

গত বছর ৯ মার্চ বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়। গতকাল এ রায়ের ৬৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ  করতে বলা হয়েছে।

রায় প্রকাশের পর দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ের ফলে ধরে নিতে হবে গত মার্চ থেকে হাজী সেলিম আইনগতভাবে আর সংসদ সদস্য নেই। আর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রক্রিয়া হচ্ছে তাকে ৩০ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। জেল থেকে ওকালতনামা দিয়ে এ রায়ের জাবেদা-নকল নিয়ে তিনি রেগুলার লিভ-টু-আপিল করতে পারবেন এবং জামিন চাইতে পারবেন।

 

অন্যদিকে হাজী সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, হাই কোর্টের রায় অনুযায়ী এক মাসের মধ্যেই বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ-টু-আপিল করা হবে।

রায়ে দুর্নীতি বা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাহস-সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাই কোর্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘আমরা সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, আপাতদৃষ্টিতে হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ থাকার পরও দুদক তাদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ, সম্পত্তির বিষয়ে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা-সাহস না দেখিয়ে দুর্ভাগ্যবশত মিডিয়া কাভারেজের ওপর নির্ভর করছে।’ একটি কার্যকর-সক্রিয় কমিশন দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে রায়ে বলা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্নীতি নির্মূল করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর জন্য আমরা সক্রিয় ও কার্যকর একটি কমিশন দেখতে চাই, যে কমিশন সাংবিধানিক পদধারী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী যে-ই হোক না কেন, খুঁজে বের করে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করবে।’

দুর্নীতিকে মানসিক রোগ উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি একটি মানসিক রোগ। শারীরিক শাস্তিতে এর নিরাময় সম্ভব নয়। এর জন্য সুবিধাপ্রাপ্ত, সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি তাদের তালিকা করে কমিশন, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের প্রধানদের দিয়ে তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করতে হবে। আমরা জানি যে এটি একটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ একজন সৎ ব্যক্তি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির শিকার হতে পারেন। কিন্তু আমাদের সভ্য ও দুর্নীতিমুক্ত স্বাধীন জাতি হতে হবে।’

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক, দার্শনিক হেনরি সিডউইককে উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক সভ্যতা একটি জাতির অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়। আর কোনো কিছু এর নির্ধারক হতে পারে না। হেনরি সিডউইকের এ বক্তব্যের আলোকে আমাদের রাজনৈতিক সভ্যতার স্তর কোন জায়গায়, তা মূল্যায়ন করতে হবে। এ ছাড়া “দুর্নীতির স্তর” দিয়েও আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রের অবস্থান নির্ধারণ করা হচ্ছে।’

রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘কারও কারও জন্য আমাদের মান-মর্যাদাহানি ঘটছে। আমরা লজ্জিত হচ্ছি। কারণ মানসিকভাবে দুর্নীতিকে বৈধতা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দেশের প্রতিটি খাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তারা শক্তিশালী ও সংগঠিত চক্র, যে কারণে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দুর্নীতিগ্রস্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।’

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং ৫৯ কোটি ৩৭ লাখ ২৬ হাজার ১৩২ টাকার তথ্য গোপনের অভিযোগে রাজধানীর লালবাগ থানায় মামলা করে দুদক। ওই মামলায় ২০০৮ সালে হাজী সেলিমকে দুদক আইনের দুটি ধারায় (২৬-এর ২ এবং ২৭-এর ১) মোট ১৩ বছর কারাদণ্ড দেয় বিশেষ জজ আদালত। ২০০৯ সালে হাজী সেলিম বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১১ সালে ওই সাজা বাতিল করে রায় দেয় হাই কোর্ট। এরপর হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে দুদক। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিত ২০১৫ সালে হাই কোর্টের রায় বাতিল করে পুনরায় শুনানি করতে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।

নির্দেশ অনুযায়ী ২০২০ সালের মামলাটি শুনানির জন্য উদ্যোগ নেয় দুদক। শুনানিতে হাজী সেলিমের মামলার যাবতীয় নথি (এলসিআর) তলব করে হাই কোর্ট। ওই নথি পাওয়ার পর গত বছরের ৩১ জানুয়ারি শুরু হয় পুনঃশুনানি। এরপর গত বছর ৯ মার্চ রায় ঘোষণা করে আদালত। একটি ধারায় (২৭-এর ১) বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে আরেকটি ধারায় তিন বছরের সাজা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছিল তাকে। গতকাল এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়।

Back to top button