সারাদেশ

গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ, এরপর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ

দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি গাজীপুরে। এরপর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দেশজুড়ে বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে।

 

গতকাল বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকীর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে দূষণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণে রাস্তার ধুলা সরানোর জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার, অবৈধ ইটখোলা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, জলাধার সংরক্ষণ, নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ বাস্তবায়নসহ ১৫টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

ndtv24

গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) যুগ্ম সম্পাদক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম, আইনবিদ মারুফা গুলশান আরা প্রমুখ।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গাজীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি দূষণ, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ২৬৩.৫১ মাইক্রোগ্রাম। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা এবং তৃতীয় অবস্থানে নারায়ণগঞ্জ রয়েছে। এই জেলাগুলোর বায়ুমান ছিল যথাক্রমে ২৫২.৯৩ ও ২২২.৪৫ মাইক্রোগ্রাম। সবচেয়ে দূষিত তিনটি শহরের বায়ুমান ছিল দৈনিক আদর্শ মানের (৬৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। এরপর চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জ।

আর সবচেয়ে কম দূষিত শহর হচ্ছে মাদারীপুর, যেখানে বায়ুমান ছিল ৪৯.০৮ মাইক্রোগ্রাম। কম দূষণের দিক থেকে পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী ও মেহেরপুর।

প্রতিবেদনে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কারকাজ, মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন, আশপাশের ইটখোলা, ছোট-বড় শিল্প-কারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোকে দূষণের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর কম দূষণের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ওই সব এলাকায় প্রচুর গাছপালা ও প্রাকৃতিক জলাধার রয়েছে। এ ছাড়া রাস্তা সংস্কারকাজের পরিমাণও কম।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ছিল মিশ্র এলাকায়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১১১.৯ মাইক্রোগ্রাম। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে বাণিজ্যিক (১১১.৪ মাইক্রোগ্রাম), রাস্তার সংযুক্তি (১১০.৮ মাইক্রোগ্রাম), আবাসিক শিল্প (১০৬.৭ মাইক্রোগ্রাম) এবং সংবেদনশীল এলাকা (১৭.৩ মাইক্রোগ্রাম)। এদিক থেকে তুলনামূলক কম দূষণ পরিলক্ষিত হয় গ্রামীণ এলাকায়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৯৪.০২ মাইক্রোগ্রাম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ১০টি জেলায় বায়ুর মান ভালো পাওয়া যায় (প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে)। জেলাগুলো হলো কুড়িগ্রাম (৬৩.৩৩ মাইক্রোগ্রাম), নাটোর (৬৩.১৯ মাইক্রোগ্রাম), জয়পুরহাট (৫৮.২৪ মাইক্রোগ্রাম), রাজবাড়ী (৫৮.২২ মাইক্রোগ্রাম), রাজশাহী (৫৬.৪১ মাইক্রোগ্রাম), পাবনা (৫৬.২২ মাইক্রোগ্রাম), সিরাজগঞ্জ (৫৫.২ মাইক্রোগ্রাম), মেহেরপুর (৫৩.৩৭ মাইক্রোগ্রাম), পটুয়াখালী (৫১.৪২ মাইক্রোগ্রাম) ও মাদারীপুর (৪৯.০৮ মাইক্রোগ্রাম)। এসব এলাকা নদীর পার্শ্ববর্তী হওয়ায় দূষণের বিস্তৃতি কম। রাজশাহী শহরে ভালো মানের বায়ু পরিলক্ষিত হওয়ার পেছনে রাজশাহী শহর কর্তৃপক্ষের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

সুপারিশ : প্রতিবেদনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। স্বল্প মেয়াদি সুপারিশে বলা হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতিদিন দু-তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটাতে হবে। নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখা এবং নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তার ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করতে হবে। অবৈধ ইটখোলা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজনে নাম্বার প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করতে হবে।

মধ্য মেয়াদি সুপারিশে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর গাছ লাগাতে এবং ছাদ বাগানে উৎসাহিত করতে হবে। আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা, দূষিত শহরগুলোর আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ, আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে স্যান্ড ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো এবং সিটি গভর্ন্যান্স প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশে নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ বাস্তবায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, গণপরিবহনসহ ট্রাফিকব্যবস্থার উন্নয়ন, গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচার এবং পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস ও পরিবেশ আদালত কার্যকর করার আহ্বান জানানো হয়।

বিশেষজ্ঞরা বললেন : বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সরকার সঠিক পরিকল্পনা নিলে ও বরাদ্দ ঠিকমতো খরচ করলে নির্মাণের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে বা এ রকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। এমনকি মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি হতে পারে।

বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি সংস্থাগুলো নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানান কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী। তিনি বলেন, বড় বড় শহরে অধিক ধোঁয়া নিঃসরণকারী গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম চলছে।

অধ্যাপক জসিম উদ্দিন বলেন, সবার আগে দূষণ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, ক্যাপসের ৮১ সদস্যের একটি গবেষকদল গত বছর ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলার তিন হাজার ১৬৩ স্থানের বায়ুর অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ পরীক্ষা করে গবেষণার ডাটা সংগ্রহ করে। সেই ডাটা বিশ্লেষণ করে দেশে প্রথমবারের মতো এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

Back to top button