ওসমানীয় দোসর হিমেল-মজিবর এখনো অধরা প্রকাশ্যে থেকেও প্রশাসনের নজরে নেই
ওসমানীয় দোসর হিমেল-মজিবর এখনো অধরা প্রকাশ্যে থেকেও প্রশাসনের নজরে নেই

স্টাফ রিপোর্টার(Somoysokal) গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলের নির্মম পরিসমাপ্তি ঘটে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি সন্ত্রাসীদের গডফাদার খ্যাত শামীম ওসমানও স্বপরিবারে পালিয়েছে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে। তবে ফতুল্লার সস্তাপুর এলাকায় তাদের দুই দোসর এখনো রয়েছে বহাল তবিয়তে। উল্টো রীতিমত এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে তারা। বলা হচ্ছে, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরি সদস্য মজিবর ও তার ভাতিজা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহরিয়া রেজা হিমেলের কথা। তারা উভয়েই ছিলেন শামীম ওসমান ও তার পুত্র অয়ন ওসমানের নিতান্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। ওসমানদের প্রভাব খাটিয়ে শিবু মার্কেট, সস্তাপুর ও কাঠেরপুলসহ আশাপাশের এলাকার সিংহভাগ এলাকার অঘোষিত মোড়ল হয়ে উঠেছিল মজিবর ও হিমেলসহ তার আরেক চাচা আনোয়ার। তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় ভূমিদস্যুতা, আধিপত্য বিস্তার, সন্ত্রাসী ও কিশোরগ্যাং বাহিনী লালন পালন এবং নানা অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। হিমেল-মজিবরকে কে বা কারা অভয় এবং শেল্টার দিচ্ছে, সেই প্রশ্নের পাশাপাশি এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদেরকে আইনের আওতায় না আনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও স্থানীয়দের মাঝে চলছে নানা সমালোচনা।
বিশেষ করে, গণঅভ্যুত্থান তথা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শামীম ওসমান ও অয়ন ওসমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নিয়েছিল মজিবর, হিমেল ও তাদের সহযোগিরা। নারায়ণগঞ্জ শহর, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে ছাত্রজনতা হত্যার ঘটনায় হিমেল-মজিবরের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। এর মধ্যে কেবল ফতুল্লা থানাতেই হিমেলের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একাধিক হত্যা মামলার মধ্যে প্রাথমিক ভাবে চারটি মামলার তথ্য হাতে এসেছে।
যেখানে দেখা গেছে, ১৬ (১১) ২৪ নম্বর মামলায় হিমেল এজাহারভুক্ত ৯৬ নম্বর আসামী। ২০ (৮) ২৪ নম্বর মামলায় ৮৭নং, ২৬ (৮) ২৪ নম্বর মামলায় ৮১ নম্বর এবং ৩০ (৮) ২৪ নম্বর মামলার এজাহারের আসামীর তালিকায় হিমেলকে ১৯৪ নম্বর আসামী করা হয়েছে। এছাড়াও ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা ও হামলার ঘটনায় ৫ আগস্টের পর হিমেল এবং তার চাচা মজিবরের বিরুদ্ধে আরও একাধিক মামলা রয়েছে ফতুল্লা সহ সদর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায়।
এরপরও এলাকায় বীরদর্পে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে তারা। স্থানীয় বিএনপি নেতা শাহিন বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে হিমেল বাহিনীর বিরুদ্ধে। এলাকায় পূর্বের ন্যায় নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে তারা। তার আরেক চাচা জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেনও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বিস্ময় প্রকাশ করে স্থানীরা বলছেন, ওসমান পরিবারের অন্যতম দোসর মজিবুর রহমান ও শাহরিয়া রেজা হিমেল আওয়ামী লীগের শাসনামলে জুলুম নির্যাতন এবং ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামী হয়েও কিভাবে বহাল তবিয়তে রয়েছে, তা যেন রহস্যে ঘেরা! ওসমান পরিবারের এই দোসরদের কে বা কারা অভয় এবং শেল্টার দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন যেমন জোড়ালো হচ্ছে, তেমনই তাদেরকে এখনো আইনের আওতায় না নেয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও চলছে সমালোচনা।
জানা গেছে, সন্ত্রাসীদের গডফাদার খ্যাত শামীম ওসমানের পুত্র অয়ন ওসমানের আস্থাভাজনদের মধ্যে অন্যতম ছিলো ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়া রেজা হিমেল। তার চাচা মজিবুর রহমানও শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন নানা ভাবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে ওসমানদের প্রভাব খাটিয়ে সস্তাপুর এলাকায় মজিবুর ও হিমেল হয়ে উঠেছিলেন এক আতঙ্কের নাম। ভূমিদস্যুতা থেকে শুরু করে মিথ্যা মামলায় হয়রানী করা এবং পান থেকে চুন খসলেই সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে হামলার ঘটনা ছিলো অনেকটা নিত্যদিনের ঘটনা। হিমেল ও তার বাহিনী অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিও দেখিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। সাধারণ মানুষ তাদের ভয়ে ছিলেন তটস্থ। অয়ন ওসমানের নাম করে প্রভাব বিস্তার ও জুলুম নির্যাতন চালানোয় হিমেল এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেনি কেউ। বর্তমানেও তারা বহাল তবিয়তে থাকায় স্থানীয়দের অনেকেই আতঙ্কে রয়েছে।
এদিকে, শাহরিয়ার রেজা হিমেল ও তার চাচা মজিবুরের বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি, জমি দখল, মারধর, মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। ইতিপূর্বে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি ভুক্তভোগী পরিবার জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছিল। পুরো পরিবারকে হত্যার পর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ এনে কাফনের কাপড় পরে ওই মানববন্ধন করেছিল প্রবাস ফেরত ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রী। প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগী পরিবারটি জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল তৎকালিন সময়ে।
জানা গেছে, হিমেল ইতিপূর্বে ছাত্রদল ও মজিবর রহমান বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের পুরো পরিবারই এক সময় বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে বিগত সময়ে তারা বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগার হয়ে যান। অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ায় হিমেল ও মজিবুর শামীম ওসমান এবং অয়ন ওসমানসহ ছাত্রলীগের রিয়াদ প্রধানকে বশ করে নিয়েছিলেন। অয়ন ওসমানকে ‘নাজরানা’ দিয়ে তুষ্ট করে হিমেল বনে যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। মজিবুর রহমানও কিছুদিন যুবলীগ নেতা পরিচয় দিতেন। একপর্যায়ে তিনিও শামীম ওসমানকে তুষ্ট করে ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরি সদস্য পদ বাগিয়ে নেয়। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগার বনে যাওয়া পরিবারটির কারণে স্থানীয় ত্যাগী ও তৃণমূলের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে হিমেল ও মজিবুর এখন বিএনপির একটি অংশকে ম্যানেজ করে এলাকায় বীরদর্পে রয়েছে।
জানা গেছে, হিমেলসহ তার বাবা শাহ্জালাল, চাচা মজিবর রহমান, শাহজাহান, জুয়েল ও আনোয়ারের বিরুদ্ধে ফতুল্লার সস্তাপুর এলাকায় ভূমিদস্যুতার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন জনের জমি দখল করারও অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ উঠেছিল হিমেল ও তার পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে।
তৎকালিন সময়ে ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে দাখিলকৃত লিখিত অভিযোগে বলেছিলেন, সস্তাপুরের লাল চান মিয়ার ছেলে শাহজালাল ও শাহজাহানসহ হিমেল ও মজিবুর গং তার সস্তাপুর মধ্যপাড়া এলাকার জমি দখল করতে চায়। এই জন্য তারা বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিচ্ছে। তারা দেশীয় দা, চাপাতি, ছুরি, হকিস্টিক, লোহার রড নিয়ে তার কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। বাড়ি থেকে উৎখাতের হুমকি দেয়। একই সাথে তাকে ও তার পরিবারের সকল সদস্যদের হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয় বলে অভিযোগ ওই ব্যবসায়ীর।
ভুক্তভোগী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা হিমেলের পুরো পরিবার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। অস্ত্র নিয়ে আমার বাড়িতে ঢুকে হিমেল ও তার বাপ-চাচা আমাদের হুমকি-ধমকি দেয়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তারা আমার তিনটা বাড়ি দখল করে রেখেছে। এখন যেই বাড়িতে আছি, সেটাও দখলের পায়তারা করছে। তাদের এই দখলদারিত্বের জন্য বাধ্য হয়ে কাতার থেকে চলে আসতে হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছিলেন নজরুল ইসলাম।
বিগত সময়ে একাধিকবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোন লাভ হয়নি দাবি করে ভুক্তভোগী ওই ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘আমি কাফনের পড়ে নামতে বাধ্য হয়েছি। আমার হারানোর আর কিছু নাই।’
এর আগে হিমেল ও তার চাচা মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তারা এক রিকশার গ্যারেজ মালিকের পরিবারকে মারধরের পর ‘মিথ্যা মামলা’ দিয়ে হয়রানি করছে। এই অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে সস্তাপুর এলাকার রিকশার গ্যারেজ মালিকের পরিবার। মামলা দিয়ে তাদের পরিবারকে হয়রানি এবং আরো মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেয়ার অভিযোগ করে মানববন্ধন করেছিলেন শফি প্রধান, তার স্ত্রী ও তিন ছেলে।
এদিকে, হিমেল ও মজিবুরের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সস্তাপুর বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা জুলহাস মিয়া। ভুক্তভোগী ওই মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, ‘অবৈধভাবে দখল করে রাখা জমি লিখে দেওয়ার জন্য কয়েকবার হুমকি দিয়েছিল হিমেল ও তার চাচা মজিবুর রহমান। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ভূমিদস্যু, সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছি।
স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং ওসমানদের দুঃশাসনের ইতি ঘটলেও তাদের দোসর মজিবর, হিমেল ও আনোয়ারের হাত থেকে এখনো রেহায় পায়নি এলাকাবাসী। তাদেরকে আইনের আওতায় আনার দাবি এখন সর্ব মহলে।